বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সারাদেশে একযোগে ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কাণ্ড অনুসন্ধানে একে একে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। সে সময় ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) ও ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) অপারেটরদের এড়িয়ে সরাসরি সাবমেরিন কেবল ও ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল ক্যাবল (আইটিসি) অপারেটরদের মাধ্যমে সারাদেশে ইন্টারনেট শাটডাউন করা হয়। সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের নির্দেশেই বন্ধ করা হয় ইন্টারনেট সার্ভিস। এ ছাড়া ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনায় জড়িত ছিলেন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মহিউদ্দিন আহমেদসহ কতিপয় কর্মকর্তা। আইটিসি অপারেটররা বলছেন, বিটিআরসির সিদ্ধান্তে ব্যান্ডউইথ সরবরাহ বন্ধ করেন তারা।
Pause
Mute
Remaining Time -10:00
Close PlayerUnibots.com
এদিকে ইন্টারনেট বন্ধের নেপথ্যে মূল কারণ কী ছিল এবং এর সঙ্গে কারা জড়িত ছিল- তা অনুসন্ধানে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (টেলিকম) একেএম আমিরুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের এ কমিটি গঠন করা হয়েছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের নির্দেশে। গতকাল মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার সঙ্গে কারা জড়িত, তা জানতে চেয়ে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন। এরপরই এ কমিটি গঠন করা হয়। জানা গেছে, কমিটি আজ সোমবারের মধ্যেই এ সংক্রান্ত একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন জমা দেবে।
বৈঠকে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ইন্টারনেট বন্ধ করা মানবাধিকারের লঙ্ঘন। কার নির্দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়, তা বের করতে হবে। মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসির কোন কোন কর্মকর্তা অতি উৎসাহী হয়ে ইন্টারনেট বন্ধে সহযোগিতা করেছেন, তা-ও খতিয়ে দেখতে হবে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকালে কারফিউ শুরুর আগে ১৭ জুলাই (বুধবার) মধ্যরাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা এবং ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ৯টা থেকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধের পর ঢাকার মহাখালীর খাঁজা টাওয়ারে ডেটা সেন্টার আগুনে পুড়ে যাওয়ার অজুহাত সামনে আনা হয় শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষ থেকে। সে সময় বলা হয়, আগুনে তার পুড়ে যাওয়া এবং অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ইন্টারনেট সার্ভিস বন্ধ হয়ে গেছে। ২২ জুলাই প্রতিমন্ত্রী পলকের নামে মোবাইল ফোন গ্রাহকদের প্রতি দেওয়া এক খুদেবার্তায় বলা হয়, সন্ত্রাসীদের অগ্নিসংযোগের কারণে ডেটা সেন্টার ও আইএসপির তার পুড়ে যাওয়ার কারণে সারাদেশে ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হচ্ছে। মেরামত করতে সময় লাগবে।
তবে তার বক্তব্য পুরোটাই মিথ্যাচার ছিল বলে জানিয়েছে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি)। সংস্থাটির সভাপতি ইমদাদুল হক আমাদের সময়কে বলেন, ত্রাণ ভবনে আগুন লাগলে সেখানকার ডেটা সেন্টার কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এ জন্য পুরো দেশের ইন্টারনেট শাটডাউন হয় না। ওইদিন রাতেই ইন্টারনেট পুরোপরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সাবেক প্রতিমন্ত্রী ডেটা সেন্টার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ইন্টারনেট বন্ধের যে দাবি করেছিলেন, তা সঠিক ছিল না। তখন আমাদের ওপরও চাপ ছিল।
এদিকে আইআইজি অপারেটররা বলছেন, তাদের এড়িয়ে সরাসরি আইটিসি অপারেটরদের ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে তারাও আইএসপিদের ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করতে পারেনি।
আইআইজি অপারেটরদের একটি সূত্র জানায়, ২৮ জুলাই দুপুরে সীমিত আকারে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু করা হলেও তাদের নির্দেশ দেওয়া হয় ফেসবুক, টিকটকসহ সকল মেটা সার্ভিস ব্লক করে রাখতে। সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলকের বরাত দিয়ে বিটিআরসি থেকে মৌখিকভাবে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে আইআইজি অপারেটরদের সংগঠন আইআইজিএবির সাধারণ সম্পাদক জোনায়েদ আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, সাধারণত যখন এ ধরনের শাটডাউন করা হয়, তখন গেটওয়ে অপারেটরদের জানানো হয়। তবে এবারই প্রথম দেখলাম, আমাদের বাইপাস করে তারা সাবমেরিন কেবল অফ করে দেয় এবং আইটিসিদের টোটাল শাটডাউন করতে বলা হয়। ফলে ওইদিন আমাদের হাতে আর কিছু ছিল না। সাবমেরিন কেবল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরাও আইএসপিদের ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করতে পারিনি।
বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবলস কোম্পানির (বিএসসি) তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে মোট ব্যান্ডউইথের চাহিদা ৫ হাজার জিবিপিএসেরও বেশি। এর মধ্যে প্রায় ২ হাজার ৭শ জিবিপিএস আসে আইটিসি লাইসেন্সের মাধ্যমে। অবশিষ্ট ২ হাজার ৪০০ জিবিপিএসের মতো ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করে বিএসসি। দুটি সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে এ ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করা হয়। ফলে আইটিসি ও সাবমেরিন কেবল বন্ধ করে দেওয়ায় কার্যত সারাদেশে ব্যান্ডউইথ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
একাধিক আইটিসি সূত্র জানায়, আন্দোলনকালে সাবেক প্রতিমন্ত্রীর মৌখিক নির্দেশে ইন্টারনেট শাটডাউন করতে তারা বাধ্য হন।
সাবমেরিন কেবল বন্ধের বিষয়ে জানতে বিএসসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যান্ডউইথ সরবরাহ বন্ধের বিষয়টি স্বীকার করেন। বলেন, আমরা তো লাইসেন্সি কোম্পানি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে যেভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আমরা সেভাবে কাজ করেছি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে বিটিআরসির চেয়ারম্যান ইঞ্জি. মহিউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। এরপর বিটিআরসির কার্যালয়ে গিয়েও তার দেখা মেলেনি। এদিকে ইন্টারনেট বন্ধের সিদ্ধান্তে নিয়মভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে বিটিআরসির এই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। বেশির ভাগ কমিশনারকেই অন্ধকারে রেখে ইন্টারনেট বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলেও জানান বিটিআরসির কমিশনাররা।
বিটিআরসির অর্থ হিসাব ও রাজস্ব কমিশনার ড. মুশফিক মান্নান চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, ইন্টারনেট বন্ধের সিদ্ধান্ত পলিসিগত সিদ্ধান্ত। বিটিআরসির নিয়ম পলিসিগত সিদ্ধান্ত নিতে হলে পুরো কমিশনের বৈঠক ডাকতে হবে। অথচ এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিটিআরসির কমিশনারদের সঙ্গে আলোচনাই করা হয়নি।
পাঠকের মতামত